প্রকৃতি চালিত হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী। দিন-রাতের আবর্তন, ঋতু পরিবর্তন, রোদবৃষ্টি - কোনো কিছুই এসব নিয়মের বাইরে যায় না। আমরা এগুলোকে Laws of Nature বলি। প্রকৃতি যেমন সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মের কাঠামোর মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়, শায়খ আল-ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহর রাহিমাহুল্লাহ মতে, মানবসমাজের ক্ষেত্রেও এমন কিছু অলঙ্ঘনীয় নিয়ম আছে।
তফাৎটা হল প্রকৃতির ক্ষেত্রে আমরা নিয়মগুলো, সেগুলোর কার্যকরণ এবং ফলাফল প্রত্যক্ষ করতে পারি। পর্যবেক্ষন করতে পারি। তাই খুব সহজে আমরা এ ব্যাপারগুলো বুঝতে পারি, প্যাটার্নগুলো ধরতে পারি। কিন্তু সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল কিছু নিয়ম নির্ধারন করে দিয়েছেন। কিন্তু আপাত না হওয়ায়, প্রত্যক্ষ না হওয়াতে আমরা এগুলো হয়তোবা অতো সহজে বুঝতে পারি না। প্যাটার্নগুলো আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু আমরা অনুধাবন করি বা না করি, এ নিয়মগুলো অনুযায়ীই জাতি, সমাজ, রাষ্ট্রের উত্থান-পতন ঘটে।
একটি ইনসাফপূর্ণ কাফির সমাজ বা রাষ্ট্র একটি ইনসাফহীন মুমিন সমাজ বা রাষ্ট্রের চেয়ে পার্থিবভাবে বেশি সফল হতে পারে। কারণ এটা সেই অলঙ্ঘনীয় নিয়মগুলোর একটি।
একই কথা দল ও ফিরকাগুলোর ক্ষেত্রেও খাটে। কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন, কিন্তু নির্দিষ্ট নীতি অনুযায়ী দল ও ফিরকাগুলোর অবস্থার পরিবর্তন হয়, উত্থান-পতন ঘটে। বাতিল ফিরকাগুলোর ক্ষেত্রে এমন একটি নিয়ম হল, এগুলো কখনো একতাবদ্ধ থাকতে পারে না। একসময় না একসময় এগুলো স্প্লিন্টার করে। এ ভাঙ্গন ধরে ভেতর থেকে। আর ভাঙ্গনের শুরুটা হয় যে নির্দিষ্ট দিকে তাদের বাতিলের ঝোঁক সেই দিক থেকে।
যেমন খারেজিরা সমস্যা তাদের চরমপন্থা বা গুলুহ। স্পেসিফিকালি তাকফিরের ব্যাপারে তাদের গুলুহ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন হারুরিয়্যাহদের মাধ্যমে প্রাথমিক খারেজিদের শুরু হলেও খুব কম সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তাদের এ বিভক্তির শুরু হয়েছিল তাকফির এবং আক্বিদার কিছু প্রশ্নে। যেমন – মুশরিকদের শিশুরা কী জান্নাতি না জাহান্নামি – এই প্রশ্ন নিয়ে খারেজিদের তিনটি আলাদা দল হয়েছিল। তারা যে বাতিল আকড়ে ধরেছিল সেই বাতিলে মাধ্যমেই আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল তাদের বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। তারা নিজেরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিল।
এই কথাগুলো বর্তমান সময়ের অন্যান্য বাতিল ফিরকাগুলো, যেমন মর্ডানিস্ট, ‘মডারেট’, নিও-মু’তাজিলা – এদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা অমোঘ ও অলঙ্ঘনীয় নিয়ম যে তারা একতাবদ্ধ থাকতে পারবে না। ক্ষনিকের জন্য তাদের যতোই শক্তিশালী, প্রভাবশালী, জনপ্রিয় কিংবা জনসমর্থনপুষ্ট মনে হোক না কেন। বাহ্যিক কোন উৎস থেকে না, আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল তাদের বাতিলের মাধ্যমে তাদেরই ভেতর থেকে তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরান।
যেমন, তথাকথিত ‘’মডারেট মুসলিম’ -দের বৈশিষ্ট্য হল দ্বীনের মৌলিক ও অপরিবর্তনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে তাদের চরম পর্যায়ের শিথিলতা। আক্বিদা, আল ওয়ালা ওয়াল বারা, ঈমান ও কুফরের সংজ্ঞা, তাওয়াল্লি, সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে কাফিরদের অনুসরন না করা, শারীয়াহ নির্ধারিত সীমা অতিক্রম না করা – এসব কিছুকে তারা নিজেদের মনমতো ব্যাখ্যা করে খেয়ালখুশি অনুযায়ী বৈধতা নির্ধারন করে। এ ব্যাপারগুলো তাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না। তাই দ্বীনের মৌলিক ব্যাপারে বিচ্যুতি ঘটলে তাদের গায়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখে, ক্লিন ইমেজ ধরে রাখা, কাফিরদের কাছ থেকে অ্যাপ্রুভাল পাওয়া, কাফিরদের চোখে ছোট না হওয়া – এগুলো তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর তাই আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল তাদের বাতিলের মাধ্যমেই তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরান, তাদের ভেতর থেকে। যারা শারীয়াহর নির্ধারিত সীমা বারবার লঙ্ঘিত হতে দেখেও দিনের পর দিন চুপ থাকে, তারাই সমাজের কাছে ‘কমিউনিটির’ ইমেজ নষ্ট হবে এই ভয়ে এর চেয়ে অনেক, অনেক তুচ্ছ জিনিষ নিয়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে যায়। নিজেরাই একে-অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়। নিজেরাই একে অপরের বাতিল উন্মোচন করতে শুরু করে। নিজেদের আবর্জনা নিজেরাই মানুষের সামনে নিয়ে আসে। আর এভাবেই বাতিলের মাধ্যমে বাতিল প্রকাশিত হয়।
এটা স্বাভাবিক। এটাই নিয়ম। অস্বাভাবিক হল, বিপর্যয় হল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছেড়ে অগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে উম্মাহর পড়ে থাকা। বিপর্যয় হল মৌলিক বিচ্যুতি সয়ে যাওয়া আর সেনসেশানালিযম নিয়ে মেতে থাকা। বিপর্যয় হল কোন বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য আর কোন বিষয়গুলো পরিত্যাজ্য সেটা বুঝতে না পারা। আর এখানেই আর-রাজীম ইবলিসের সাফল্য।
আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের সবাইকে আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবার তাউফিক্ব দান করুন।