[ক]
আজ অনেক বছর ধরে আমরা ‘স্বাধীনতা’, ‘মুক্তি’ ইত্যাদির কথা শুনছি। স্বাধীনতার শাব্দিক অনেক অর্থ আছে। কিন্তু কোন রাজনৈতিক, অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক, বুদ্ধিজীবি কিংবা মিডিয়া যখন স্বাধীনতা কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে তখন তারা শাব্দিক অর্থ বোঝায় না। তারা একটা নির্দিষ্ট ধারণা কথা বলে। এই ধারণাটা এসেছে লিবারেলিযম থেকে।
লিবারেল দর্শনে যেটাকে স্বাধীনতা বলা সেটা আসলে স্রষ্টার কাছ থেকে সৃষ্টির স্বাধীনতা। স্রষ্টার আনুগত্য ও ইবাদত থেকে বের হয়ে যাওয়া। আর এই ‘স্বাধীনতা’র ফলাফল হল আত্মউপাসনায় মগ্ন হওয়া। যদিও তাদের অধিকাংশ এটা উপলব্ধি করে না।
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের জানিয়েছেন মিথ্যা উপাস্য বিভিন্ন রকমেরর হয়। এর মধ্যে কিছু উপাস্য বাহ্যিক, যেমন মূর্তি। আর কিছু হল মানুষের আভ্যন্তরীণ।
আল্লাহ্ ‘আযযা ওয়া জাল বলেন –
তুমি কি তাকে দেখেছো, যে তার প্রবৃত্তি, খেয়াল-খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? এবং জ্ঞান বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ্ তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন। এবং তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর স্থাপন করেছেন আবরণ। অতএব, কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা? [তরজমা, সূরা আল-জাসিয়াহ, ২৩]
অর্থাৎ মানুষ তার প্রবৃত্তি – খেয়ালখুশি – কামনাবাসনাকে ইলাহ বানিয়ে নেয়। উপাসনা করে। তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় নিজের খেয়ালখুশি পূরণ করা। খাবার, পানীয়, দামী পোশাক, বড় বাড়ি – এসব অর্জনের আনন্দ তার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। চোখের সুখ, কানের সুখ, শরীরের সুখের পেছনে সে ছুটে বেড়ায়। সে তার যৌনাঙ্গের ইবাদত করে, সে তার কামনাবাসনার পূজা করে। এসব আনন্দের পেছনে সে ছুটে বেড়ায়। এইসব অতৃপ্ত পিপাসায় নিজেকে নিমজ্জিত করে।
সে জানে সে কী করছে, কিন্তু সে নিজেকে থামায় না। কামনাবাসনা যখন মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়, তখন তার জ্ঞান, তার বিবেচনাবোধ কোন কাজে আসে না। আল্লাহ্ তার শ্রবণ, দৃষ্টিশক্তি ঢেকে দেন। একারণেই বলা হয় খেয়ালখুশি, কামনা মানুষের বোধবুদ্ধি ঢেকে দেয়। এমন মানুষ আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আসা বার্তা অনুধাবন করতে পারে না। সে তার নিজের খেয়ালখুশির উপাসনা করে যায়।
লিবারেলিসম বাহ্যিক ইলাহর ইবাদতকে আভ্যন্তরীণ ইলাহর ইবাদতে পরিণত করেছে। আজকের পশ্চিম তার কামনাবাসনা আর খেয়ালখুশির উপাসনা করে। যে কারণে তাদের বিশ্বাস, দর্শন, মূল্যবোধে আচরণ, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বিকৃতি। তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে গেছে নফসের চাহিদা মেটানো। খেয়ালখুশির পেছনে ছুটে বেড়ানো। কামনাবাসনার ইবাদত করা। এটাকে তারা স্বাধীনতা মনে করছে। তারা মনে করছে তারা স্বাধীন, মুক্ত। কিন্তু বাস্তবতা হল তারা তাদের প্রবৃত্তির গোলামী করে।
আল্লাহ্ কুরআনে বলেছেন,
মানুষ কি মনে করে তাকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে? [তরজমা, সূরা কিয়ামাহ, ৩৬]
সুদা (سُدًى) মানে আদেশ না করা, নিষেধ না করা। অর্থাৎ মানুষ কি মনে করে তাকে কোন হুকুম করা হবে না? কোন কিছু থেকে নিষেধ করা হবে না? সে কি মনে করে তাকে দুনিয়াতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হবে, তার ওপর শরীয়াহর কোণ বিধিনিষেধ থাকবে না আর সে যা খুশি তাই করতে থাকবে?
এই আয়াতের ব্যাপারে সা’ইদ বিন যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন –(এর অর্থ হল) মানুষ কি মনে করে তাকে হুকুম করা হবে না? অথবা নিষেধ করা হবে না? ইবনু জারির আত-তাবারি এই উদ্ধৃতি বর্ণনা করেছেন।
আশ-শাফে’ঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আলিমগণের ইজমা হল এই আয়াতে সুদা (سُدًى)-এর অর্থ হল হুকুম না দেয়া অথবা নিষেধ না করা।
লিবারেলিযমের সবচেয়ে ভালো সংজ্ঞা পাওয়া যায় এই আয়াতে। এই আয়াত সবচেয়ে স্পষ্টভাবে লিবারেলিযমের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে। আমার মতে যেটাকে তারা ‘স্বাধীনতা ‘বলে সেটার জন্য উপযুক্ত শব্দ হল সুদাউইয়্যাহ। আধুনিক লিবারেল মানুষ মনে করে তাকে হুকুম করার মতো কেউ নেই। কেউ তার ওপর রাজত্ব করে না। কোন কিছু তার জন্য নিষিদ্ধ না। সে কারো কথা শোনে না। কারো আনুগত্য করে না। তার মন যা চায়, সেটাই সে করে। বাস্তবে সে তার খেয়ালখুশির ইবাদত করে। নিজের প্রবৃত্তির গোলামি করে। বাহ্যিক ইলাহের দাসত্ব ছেড়ে সে আভ্যন্তরীন ইলাহের দাসত্ব করে।
শায়খ আব্দুল আযীয আত-তারিফির বক্তব্য অবলম্বনে।
[খ]
প্রজারা যতক্ষণ মুক্তি কিংবা বিদ্রোহের ব্যাপারে বেখবর থাকে, ততক্ষণ নাচগান, মদ আর মাংস নিয়ে তাদের উন্মাদনায় বাগড়া দেয় না রাজা। বরং সস্তা সুখ নিয়ে গোলামদের ব্যস্ততার সুযোগে নির্বিঘ্নে ছিনিয়ে নেয় তাদের সম্মান আর মানবতা।
এই হলো আজকের আধুনিক প্রজাদের ‘মুক্তি’ আর ‘অধিকার’ এর বাস্তবতা। অধিকার আর স্বাধীনতা হলো ওইসব সস্তা সুখ আর সাময়িক বিনোদন কেনার সক্ষমতা, যা দাসত্বকে টিকিয়ে রাখে। দীর্ঘায়িত করে।
এ এক শেকলে বাঁধা স্বাধীনতা।
রাজারা জনগণের ধনসম্পদ, সহায়-সম্বল ‘বৈধভবে’ লুট করে। দেনার বোঝা কাঁধে নিয়ে আত্মহত্যা করে মানুষ। শেয়ারবাজারে সর্বস্ব হারিয়ে ঝাপসা চোখে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত। বাধ্য হয়ে ডাস্টবিনে কুকুরের পাশে উবু হয়ে বসে খাবারের খোঁজ করে শিশু। বেকার হয়ে ডিগ্রি হাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায় যুবক। নিজ ভিটে থেকে বিতাড়িত হয় কৃষক। পঙ্গু হয়ে যায় অর্থনীতি। কাল যে সম্মানিত ছিল আজ সে হয় লাঞ্ছিত। অন্যদিকে রাজা আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা গাড়ি-বাড়ি, পোশাক থেকে শুরু করে খাবার-দাবার, এমনকি হাতঘড়ির পেছনেও ওড়ায় কোটি কোটি টাকা।
এই রাজারাই মুসলিম উম্মাহর ধন-সম্পদ তুলে দেয় উম্মাহর শত্রুদের হাতে। লুট করা সেই টাকা দিয়ে বানানো মিসাইলের আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয় মুসলিম শিশুদের দেহ।
এই হলো আমাদের আজকের বাস্তবতা।
দুরবস্থার এই সময়ে প্রজাদের কী দেয় রাজারা? গোলামকে শান্ত করতে কী দেয় মনিব?
মনিব তার গোলামদের ‘স্বাধীনতার সীমানা’ বাড়িয়ে দেয়।
কেমন স্বাধীনতা জানেন?
গোলাম চাইলে ইচ্ছেমতো নাচতে পারবে, গাইতে পারবে, মাতাল হবে, নগ্ন হবে। যখন ইচ্ছে যার সাথে ইচ্ছে শোবে, নেশা করবে। সব সীমালঙ্ঘন করবে, দ্বীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।
এভাবে স্বাধীনতার তোড়ে দিন দিন বাড়বে ওদের পরাধীনতা। গোলামের গায়ে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসবে শেকলের বাঁধন।
এ এক অদ্ভুত স্বাধীনতা, জনগণের নতুন আফিম।
কৌশলটা চমৎকার। আমরা এক ঢিলে দুই পাখি মারার কথা বলি। এই কৌশলে এক ঢিলে তিন পাখি মারা পড়ে:
১। শোষিত, নির্যাতিত জনগণ চেপে রাখা আবেগ, কষ্ট, ক্ষোভ উগড়ে দেয়ার একটা পথ পায়। তারা বিদ্রোহ করে। তবে শোষকের বিরুদ্ধে না। তারা বিদ্রোহ করে ওই দ্বীনের বিরুদ্ধে, যা তাদের মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে।
২। ‘স্বাধীনতা’ নামের আফিম দিয়ে অনুভূতির দেয়াল অবশ করে ছিনিয়ে নেয়া হয় মানুষের মুক্তি ও সম্মান। ছিনিয়ে নেয়া হয় যুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি— দ্বীন। মুক্তি, সম্মান দ্বীন হারিয়ে মানুষ পরিণত হয় নফস আর কামনা দ্বারা চালিত পশুতে। যাকে নিশ্চিন্তে গোলামির বাঁধনে আজীবন আটকে রাখা যায়।
৩। রাজা আর প্রজা দুজনেই আন্তর্জাতিক ক্রুসেইডার-যায়োনিস্ট শাসকগোষ্ঠীর গোলাম থেকে যায়।
প্ল্যানটা প্রায় নিখুঁত বলা চলে। তবে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার একটা শর্ত আছে। আগে সরিয়ে দিতে হবে এতে বাগড়া দেয়ার মতো সব মানুষগুলোকে। ওইসব মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে যারা সাহাবী রিবি’ ইবনু আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে মানুষকে বলে,
'আল্লাহ আমাদের পাঠিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব থেকে স্রষ্টার দাসত্বে নিয়ে আসতে। সমস্ত বাতিল ধর্মের জুলুম থেকে মানুষকে মুক্ত করে দ্বীন ইসলামের ইনসাফের দিকে আনতে। এবং দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রশস্ততার দিকে নিয়ে যেতে।'
একবার এমন চিন্তা করা, এমন কথা বলা মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে নিশ্চিন্তে বাস্তবায়ন করা যাবে মাস্টারপ্ল্যান। সবাইকে সস্তা সুখের উল্লাসে ব্যস্ত রেখে লুটে নেয়া যাবে মানবজাতির দুনিয়া ও আখিরাত। তাই আজ আন্তর্জাতিক শাসকগোষ্ঠী আর আঞ্চলিক রাজাদের প্রথম টার্গেট এই মানুষগুলো। সব অস্ত্র তাক করা তাদের বুকে। সব প্রপাগ্যান্ডার তীর তাদের দিকে। তাঁদেরই থামাতে মহাসমারোহের আয়োজন।
ইয়াদ আল কুনাইবি