আরব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, কূটনৈতিক, সেনাপতি। রাসূলুল্লাহর ﷺ সাহাবী। ‘আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। স্ট্র্যাটিজিস্ট, প্র্যাগম্যাটিস্ট, রিয়েলিস্ট। ‘আমর ইবনুল আস রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, জন্মগত নেতা এবং অত্যন্ত তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন। তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আপনার চিন্তায় উঁকি দিতে পারতেন।
আমর ইবনুল আসের ইসলাম গ্রহনের আগের কথা। মুসায়লামা আল-কাযযাব তখন নিজেকে নবী বলে দাবি করা শুরু করেছে। ক্বুরাইশদের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল নিয়ে ‘আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু গেলেন মুসায়লামার সাথে দেখা করতে। মুসায়লামা প্রশ্ন করলো – হিজাযের নবীর উপর কী ধরনের বাণী নাযিল হচ্ছে?
‘আমর বললেন – তার প্রতি একটি অতি সংক্ষিপ্ত অথচ হৃদয়স্পর্শী ওয়াহি কিছুদিন আগে নাযিল হয়েছে। তা হল -
কালের শপথ, নিশ্চয়ই মানুষ ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান এনেছে সৎকর্ম করেছে এবং এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্য ধারণে পরস্পরকে উদ্ধুদ্ধ করে।
মুসায়লামা মাথা নিচু করে কিছুক্ষন চিন্তা করলো। তারপর মাথা তুলে ‘আমরের দিকে তাকিয়ে বললো – আমার উপরও এই ধরনের কিছু নাযিল হয়েছে। মুসায়লামা আবৃত্তি করা শুরু করলো –
হে ওয়াবর, হে ওয়াবর। তুমি তো শুধু দুটো কান আর বুকবিশিষ্ট, আর তোমার বাকিটা তা তো শুধুই গর্তমাত্র। [ইবনু কাসীরের মতে ওয়াবর হল লম্বা কান ও বড় বুকবিশিষ্ট বিড়ালের চাইতে ছোট এবং কুৎসিত একটি প্রানী]
মুসায়লামা ‘আমরের দিকে তাকালো। কেমন বুঝলে, ‘আমর?
‘আমর বললেন – আল্লাহর কসম মুসায়লামা, তুমি অবশ্যই জান যে আমি জানি, তুমি মিথ্যা বলছো।
সাধারণত মানুষ বলে– আল্লাহর কসম তুমি মিথ্যা বলছো। কিন্তু ‘আমর আরো এক ডিগ্রি গভীরে গেলেন। এক লাইনে পরিস্কার করে দিলেন মুশরিক-মুসলিম সবার কাছেই এটা পরিষ্কার যে মুসায়লামা ভন্ড ছাড়া আর কিছুই না। সে যে ভন্ড সে নিজেও তা জানে। আর সে এটাও জানে তার ভন্ডামী মানুষের কাছে স্পষ্ট। ‘আমর ইবনুল আসের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণ জিহ্বার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা এ অসাধারন উত্তর থেকে পাওয়া যায়। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ষষ্ঠ খন্ড, ইজাযুল ক্বুর’আন, আবু বাকর বাকিল্লানি ]
‘আমর ইবনুল আস ইসলাম গ্রহন করেন হুদাইবিয়ার সন্ধির পর। বদর, উহুদ ও খন্দকে তিনি রাসূলুল্লাহর ﷺ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। হুদাইবিয়ার বারবার পরাজয়ের পর হতাশ হয়ে পড়লেও তিনি ইসলাম গ্রহনে প্রস্তুত ছিলেন না। বরং তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ক্বুরাইশরা সবাই যদি মুসলিম হয়ে যায় তবুও তিনি ইসলাম গ্রহন করবেন না। কিন্তু হুদাইবিয়ার সন্ধির পর তিনি নিশ্চিত হয়ে যান, যেভাবে ঘটনাপ্রবাহ এগোচ্ছে তাতে পরের বছরই মুহাম্মাদ ﷺ বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করবেন। এ অবস্থায় শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি এবং তার একান্ত অনুগত কিছু সাথী নাজ্জাশীর কাছে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। যদি মুহাম্মাদ ﷺ বিজয়ী হন তাহলে তিনি নাজ্জাশীর অধীনে থাকবেন তবুও মুসলিম হবেন না। আর যদি ক্বুরাইশরা জিতে যায় তাহলে তারা মক্কায় ফিরে যাবেন। কিন্তু নাজ্জাশীও যখন মুহাম্মাদ ﷺ এর নবী হওয়া এবং ইসলামের সত্য হবার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন তখন ‘আমর ইসলাম গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নেন ।
মদীনাতে ‘আমর প্রবেশ করেন আস-সাইফুল্লাহ মাসলুল খালিদ ইবনুল ওয়ালিদের সাথে। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাদেরকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন এবং সাহাবিদের বললেন বলেন – মক্কা তার কলিজার টুকরোগুলো তোমাদের দিকে ছুড়ে দিয়েছে। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।
‘রাসূলুল্লাহর হাতে ইসলামের বাইয়াত করার সময় তিনি শর্ত দিলেন – আমি ইসলাম গ্রহন করছি এই শর্তে যে আমি আগে যা গুনাহ করেছি তা ক্ষমা করে দেওয়া হবে, আর যা এখন করছি তার জন্য আমাকে জবাবদিহি করতে হবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন – ইসলাম তার পূর্বের সবকিছু মিটিয়ে দেয়, আর হিজরতও তার পূর্বের সবকিছু মিটিয়ে দেয়।
[সীরাতু ইবন হিশাম, ২য়, ২৭৬-২৭৮, আল-ফাতহুর রাব্বানী খণ্ড-২২, মুসনাদে ইমাম আহমাদ, হায়াতুস সাহাবা-১/১৫৭-৬০, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, চতুর্থ খন্ড]
অনেক পরে ইসলাম গ্রহন করলেও রাসূলুল্লাহ ﷺ ‘আমর ইবনুল আস এবং খালিদ ইবনুল ওয়ালিদকে উচ্চপদ ও মর্যাদা দান করেন। আর এর কারন ছিল তাদের সহজাত নেতৃত্বগূন এবং যোগ্যতা।
তার চালচলন, আচরণ, দৈহিক গঠন, কথার ধরন ইত্যাদির মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠতো যে, তিনি নেতৃত্বের জন্যই জন্মেছেন। বর্ণিত আছে, আমীরুল মু’মিনীন সাইয়্যেদিনা উমার ইবনুল খাত্তাব একদিন তাকে আসতে দেখে প্রথমে একটু হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, ‘আমীর বা নেতা হওয়া ছাড়া আবু আবদিল্লাহর (‘আমরের কুনিয়াহ) পৃথিবীতে হেঁটে বেড়ানো উচিত নয়।’ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন। [রিজালুন হাওলার রাসূল -৬১৮, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা]
পার্থিব সকল বিচারে তিনি ছিলেন ঈর্ষনীয় সাফল্য ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ ছিলেন না। তিনি দুনিয়াকে বুঝেছিলেন আর দুনিয়ার সাফল্য পেয়েছিলেন। তিনি দ্বীনকে বুঝেছিলেন এবং দ্বীনের সাফল্যও পেয়েছিলেন, রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। বিচক্ষণতা, অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি ও চতুরতায় যার সমকক্ষ খুব বেশি মানুষ এই উম্মাহর মাঝে আসে নি।
‘আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রায়ই বলতেন – আমি এমন ব্যক্তির কথা ভেবে খুব অবাক হই যার মৃত্যু উপস্থিত হয়েছে, তার হুশ আছে, সে কথা বলতে পারছে কিন্তু তবুও সে মৃত্যুযন্ত্রণার কথা বলতে পারছে না।
মৃত্যু নিয়ে আমাদের মধ্যে বিপরীতমুখী চিন্তা কাজ করে। একদিকে আমরা মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চাই। অন্যদিকে মৃত্যুর মূহুর্ত, মৃত্যু যন্ত্রণা, মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে আমাদের মধ্যে তীব্র কৌতুহল কাজ করে। এজন্যই দেখবেন পশ্চিমা বিভিন্ন টিভি শো, ম্যাগাযিন ইত্যাদিতে খুব আগ্রহ নিয়ে near-death experience নিয়ে আলোচনা করা হয়। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় মরতে মরতে বেঁচে গেছে এমন মানুষদের অভিজ্ঞতা নিয়ে লম্বা লম্বা আর্টিকেল লেখা হয়। ভিডিও বানানো হয়। এসব মানুষেরা বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। কেউ বলে মৃত্যুর কাছাকাছি মূহুর্তে তার মনে হয়েছে সে অন্ধকার কোন টানেলে ঢুকে যাচ্ছে। কেউ বলে তার মনে হয়েছে উজ্জল কোন আলোর দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে। কেউ শরীর থেকে বের হয়ে যাবার কথা বলে, কেউ অদ্ভূত কোন প্রানী বা সত্তার উপস্থিতি অনুভব করার কথা বলে। অধিকাংশ মানুষ বেশ আগ্রহ নিয়ে এধরনের আলোচনা শোনে। মৃত্যুর মুহুর্তটি কেমন তা জানার ইচ্ছে আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি কাজ করে। তবে এধরনের লোকদের কথাটা কতোটুক সত্য আর কতোটুক ড্র্যামাটিক ইফেক্টের জন্য বানানো গল্প তা বোঝা মুশকিল। তবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত দীর্ঘ হিসেব নিকেশের পর নেওয়া, প্রতিটি কথা মেপে বলা, 'আমর ইবনুল আস যখন কোন কিছু বলেন তখন অবশ্যই তা গুরুত্বের সাথে নেওয়ার মত।
যখন ‘আমরের মৃত্যুর মূহুর্ত এসে উপস্থিত হল, তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ বলেন তাকে তার প্রায়ই বলা কথাটা মনে করিয়ে দিলেন এবং বললেন – আপনি এখন সেই ব্যক্তি…
‘আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন – পুত্র! মৃত্যুযন্ত্রণার প্রকৃত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। তারপরও আমি কিছুটা বর্ণনা দিচ্ছি। আল্লাহর কসম, আমার মনে হচ্ছে আমার কাধের উপর বিশাল পাহাড় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার আত্মা যেন সূচের ছিদ্র দিয়ে টেনে বের করা হচ্ছে। আমার পেট যেন কাঁটায় ভরপুর। আকাশ আর পৃথিবী যেন একসাথে মিশে গেছে, আর আমি এ দুইয়ের মাঝে পিষ্ট হচ্ছি।
[আত-তাযকিরাহ, আল-ক্বুরতুবি]
এ হল এমন একজন ব্যক্তির কথা যিনি আল্লাহর রাসূলের ﷺ সাহাবী, যিনি রাসূলুল্লাহর ﷺ কাছ থেকে ক্বুর’আন শিখেছেন, তার ﷺ পেছনে নামায পড়েছেন, তার ﷺ কাছ থেকে ইসলাম শিখেছেন, তার ﷺ নেতৃত্বে জিহাদ করেছেন, আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেছেন এবং ইসলামের জন্য নিজের সময় ও সম্পদ ব্যয় করেছেন।
আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?