ষোড়শো শতাব্দীতে শুরু হওয়া প্রটেস্টান্ট রিফর্মেইশান (Protestant Reformation) খ্রিষ্টজগতে এক মারাত্বক সংকট তৈরি করে। এ সংকটের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রোটেস্ট্যাট ধারা। প্রটেস্টান্টরা ক্যাথলিক চার্চ থেকে আলাদা হয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। শুরু হয় ক্যাথলিক চার্চ এবং প্রোটেসট্যাটদের মধ্যে সংঘাত। অল্প কিছুদিনের মধ্যে নানা দলে বিভক্ত হয়ে নিজের মধ্যেও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে প্রটেস্টান্টরা। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ইউরোপের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল এই রিফর্মেইশান। এই দাবি ঠিক না বেঠিক তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে এতোটুকু নিশ্চিত যে মডার্নিটির সৃষ্টিতত্ত্ব লিখতে হলে বারবার প্রটেস্টান্ট রিফর্মেইশানের কাছে ফিরে যেতেই হবে।

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেইশানের আনুষ্ঠানিক শুরুটা মার্টিন লুথার (মৃত্যু, ১৫৪৬ খ্রি./ দশম হিজরি, জার্মানি) থেকে। প্রথম দিকে লুথার ছিল একজন সন্ন্যাসী (monk) এবং আলিম। পরে সে ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি এবং বেশ কিছু আকীদাহ, বিধান ও আচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ক্যাথলিক চার্চে পুরোহিততন্ত্রের ধারণা ছিল। এই ধারণা মতে স্রষ্টা কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মাধ্যমে কাজ করেন। তারা স্রষ্টার পক্ষ হয়ে ব্যাপটিসম, ইউক্যারিস্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। এই বিশেষ শ্রেনী হল পাদ্রী বা পুরোহিতরা।

কিন্তু লুথার এবং পরবর্তীতে তার অনুসারীরা এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষ পুরোহিত শ্রেনীর বদলে লুথার বলে Priesthood of all believers এর কথা – অর্থাৎ সব বিশ্বাসীই পাদ্রী। অর্থাৎ বিশ্বাসীদের এমন কোন নির্দিষ্ট শ্রেনী নেই যারা স্রষ্টা এবং মাসীহের পক্ষ থেকে জ্ঞান কিংবা ক্ষমার মতো বিষয়ে মধ্যস্থতা করবে। টাকার বিনিময়ে জান্নাতের টিকিট (indulgence) বিক্রি করবে অথবা স্রষ্টার পক্ষ থেকে বাইবেলকে এক্সক্লুসিভভাবে ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন করবে। লুথারের ধারণা ছিল বিশেষ পুরোহিত শ্রেনীর এই ধারণা ভিত্তি বাইবেল না, বরং ট্র্যাডিশান। তাই তা পরিত্যাজ্য। পুরোহিততন্ত্রের ধারণার পাশাপাশি ট্র্যাডিশানকেওঅনেকাংশে প্রত্যাখ্যান করে।

পুরোহিততন্ত্রে বিশ্বাসের একটা ফলাফল হল ধর্মীয় বিশ্বাস-শিক্ষা ব্যাখ্যা করা, বোঝা এবং বাস্তবায়নের ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণদের মনোপলির মতো। অন্যদিকে Priesthood Of All believers –এর ধারণার ব্যাপারটা পুরোপুরি উল্টো। এই চিন্তার ফলাফল হল–শুধু পুরোহিত বা আলিমরা না, বরং সব বিশ্বাসী-ই বাইবেলকে পড়ার,  ব্যাখ্যা করার, এবং এর শিক্ষা বাস্তবায়নের অধিকার রাখে। এই অধিকার নির্দিষ্ট  কোন শ্রেনীর জন্য সংরক্ষিত না। পাদ্রীরা স্রষ্টা আর মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী/মিডিয়াম (medium) না। সব বিশ্বাসী নিজেই পাদ্রী। সব বিশ্বাসী সমান। বিশ্বাসী সরাসরি স্রষ্টার ইবাদত করবে। ব্রোকার হিসেবে চার্চ, পোপ কিংবা পাদ্রীকে লাগবে না। চার্চের অফিশিয়াল শিক্ষাকে আকড়ে রাখা জরুরী না, বরং প্রত্যেক বিশ্বাসী নিজেই বাইবেল ব্যাখ্যা করতে পারবে। 

লুথারের মূল অর্থ এবং উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় এই ধারণার অবধারিত এবং যৌক্তিক উপসংহার হল চরম মাত্রার আপেক্ষিকতা। সবাই নিজের মতো করে দ্বীনকে ব্যাখ্যা করবে। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী দলে দলে বিভক্ত হবে। ফলাফল হল অ্যানার্কি। বিশৃঙ্খলা। সবাই নিজ নিজ খেয়ালখুশিমতো ব্যাখ্যা করবে। প্রটেস্টান্টদের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছে। সর্বনিম্ন এস্টিমেট অনুযায়ী প্রটেস্টান্টদের ২০০-এর ওপর শাখা-উপশাখা আছে। অনেক হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি। টেক্সট ব্যাখ্যার কর্তৃত্ব যখন সবার থাকবে তখন সেটার অবধারিত

.

প্রটেস্টান্ট চিন্তার এইদিকগুলো আধুনিকতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আধুনিক চিন্তার ভিত্তির মধ্যে এধরণের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। যেমন – ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ করা। মডার্নিটি মনে করে, বিশ্বাস করে ধর্মকে একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেব রাখা জরুরী। সবাই নিজে ব্যাখ্যা করবে, ব্যাখ্যা ভিন্ন হবে, ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মানুষ একমত হতে পারবে না। মীমাংস করার কোন মেকানিসম নেই। তাই ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হবে। সমাজ ও শাসনের ক্ষেত্রে ধর্মের জায়গায় আনতে হবে অন্য কিছু। চার্চের বদলে আনতে হবে রাষ্ট্রকে। পশ্চিমের ক্লাসিকাল লিবারেল চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে আমাদের দেশের হাল আমলের লিবারেল মিশনারী পর্যন্ত সবাই এ যুক্তি ব্যবহার করে।

.

আধুনিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ র‍্যাডিকাল ইভিভিযুয়ালিসম (radical individualism)-এর শেকড়ের সাথেও প্রটেস্টান্ট চিন্তার সম্পর্ক পাওয়া যায়। যেমনটা একটু আগে বললাম, Priesthood of all believers বা ‘সব বিশ্বাসী-ই পাদ্রী’-জাতীয় চিন্তার অবধারিত ফলাফল হল ধর্মের ব্যাখ্যাকে আপেক্ষিক করে ফেলা। ব্যাখ্যা করার জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্ব যেহেতু ব্যক্তির তাই সবাই নিজের মতো করে ধর্মকে ব্যাখ্যা করবে। একটু বদলে নিয়ে মডার্নিটি এই অবস্থানকে  নিজের ভেতর ধারণ করেছে। মডার্নিটি ন্যায়অন্যায় আর নৈতিকতার ভিত্তি বানিয়েছে মানুষকে-ব্যক্তিকে-‘আমিত্ব’কে। সত্য আর নৈতিকতার মাপকাঠি হল ব্যক্তি। ব্যক্তিই এগুলোর সীমানা ঠিক করবে। অন্যের ক্ষতি কিংবা সামগ্রিক ক্ষতি না করার আগ পর্যন্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন। যা ইচ্ছে তাই সে করতে পারবে।

ধর্ম যেহেতু ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাই নৈতিকতার হিসেব হবে সমান্তরাল অক্ষে। কোন ভার্টিকাল অক্ষ নেই। "সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই"।

ওপরের দিকে তাকানো যাবে না। মানুষের ওপরে থাকা, উচ্চতর কোন সত্ত্বার দোহাই দিয়ে ন্যায়-অন্যায়, ঔচিত্যের কথা বলা যাবে না। বেশি থেকে বেশি পাশের অন্য মানুষের দিকে তাকানো যাবে। যাচাই বাছাই হবে আমার ভালোলাগার ভিত্তিতে, অথবা অন্য মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা মাথায় রেখে অথবা সামষ্টিক মানবিক বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে। সব হিসেব নিকেশ হবে মানুষিক সমতলে। একইভাবে মডার্নিটির ট্র্যাডিশান-বিরোধিতার শেকড়ও খুঁজে পাওয়া যায় প্রটেস্টান্ট চিন্তায়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও নৈতিক চিন্তা অনেকাংশে এই অবস্থানগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

ইন্ট্রেস্টিংলি আধুনিক সময়ের যেসব তথাকথিত ‘কুরআন-ঔনলি মুসলিম’ আছে তাদের অবস্থান প্রটেস্টান্ট চিন্তার এ দিকগুলোর সাথে মিলে যায়। তারা হাদীসকে অস্বীকার করে, আলিমদের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং মনে করে কুরআন পড়েই কিংবা কুরআনের তরজমা পড়েই যে কেউ তা ব্যাখ্যা করতে পারবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের এ অবস্থান নেয়ার কারণ হল কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যাকে মডার্নিটির ওয়ার্ল্ডভিউয়ের সাথে মেলাতে না পারা। তাই হাদীসকে অস্বীকার করে আধুনিকতার কাঠামোর ভেতরে তারা কুরআনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে চায়। মডার্নিস্টদের ব্যাপারটাও অনেকটা একই ধরণের। ঢালাওভাবে হাদীস অস্বীকার না করলেও তারা মোটামুটি খেয়ালখুশি মতো হাদীস গ্রহণ-বর্জন করে। পাশাপাশি ইসলামের ইলমী সিলসিলা এবং আলিমদের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বকে খারিজ করে। তথাকথিত ‘আহলে কুরআন’ এবং মডার্নিস্ট চিন্তাধারার বিচ্যুতি তাই মডার্নিটির ভেতর থেকে জন্ম নেয়া। মডার্নিটির আগ্রাসনে দিশেহারা হয়ে তারা আসলে তিন-চারশো বছরের পুরনো ইউরোপীয় খ্রিস্টান মানহাজকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এরাই বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ এবং মুক্তচিন্তার দাবি করে!

প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেইশানের আনুষ্ঠানিক শুরুটা মার্টিন লুথার (মৃত্যু, ১৫৪৬ খ্রি./ দশম হিজরি, জার্মানি) থেকে। প্রথম দিকে লুথার ছিল একজন সন্ন্যাসী (monk) এবং আলিম। পরে সে ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি এবং বেশ কিছু আকীদাহ, বিধান ও আচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ক্যাথলিক চার্চে পুরোহিততন্ত্রের ধারণা ছিল। এই ধারণা মতে স্রষ্টা কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মাধ্যমে কাজ করেন। তারা স্রষ্টার পক্ষ হয়ে ব্যাপটিসম, ইউক্যারিস্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান পালন করে। এই বিশেষ শ্রেনী হল পাদ্রী বা পুরোহিতরা।

কিন্তু লুথার এবং পরবর্তীতে তার অনুসারীরা এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষ পুরোহিত শ্রেনীর বদলে লুথার বলে Priesthood of all believers এর কথা – অর্থাৎ সব বিশ্বাসীই পাদ্রী। অর্থাৎ বিশ্বাসীদের এমন কোন নির্দিষ্ট শ্রেনী নেই যারা স্রষ্টা এবং মাসীহের পক্ষ থেকে জ্ঞান কিংবা ক্ষমার মতো বিষয়ে মধ্যস্থতা করবে। টাকার বিনিময়ে জান্নাতের টিকিট (indulgence) বিক্রি করবে অথবা স্রষ্টার পক্ষ থেকে বাইবেলকে এক্সক্লুসিভভাবে ব্যাখ্যা ও বাস্তবায়ন করবে। লুথারের ধারণা ছিল বিশেষ পুরোহিত শ্রেনীর এই ধারণা ভিত্তি বাইবেল না, বরং ট্র্যাডিশান। তাই তা পরিত্যাজ্য। পুরোহিততন্ত্রের ধারণার পাশাপাশি ট্র্যাডিশানকেওঅনেকাংশে প্রত্যাখ্যান করে।

পুরোহিততন্ত্রে বিশ্বাসের একটা ফলাফল হল ধর্মীয় বিশ্বাস-শিক্ষা ব্যাখ্যা করা, বোঝা এবং বাস্তবায়নের ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ব্রাহ্মণদের মনোপলির মতো। অন্যদিকে Priesthood Of All believers –এর ধারণার ব্যাপারটা পুরোপুরি উল্টো। এই চিন্তার ফলাফল হল–শুধু পুরোহিত বা আলিমরা না, বরং সব বিশ্বাসী-ই বাইবেলকে পড়ার,  ব্যাখ্যা করার, এবং এর শিক্ষা বাস্তবায়নের অধিকার রাখে। এই অধিকার নির্দিষ্ট  কোন শ্রেনীর জন্য সংরক্ষিত না। পাদ্রীরা স্রষ্টা আর মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী/মিডিয়াম (medium) না। সব বিশ্বাসী নিজেই পাদ্রী। সব বিশ্বাসী সমান। বিশ্বাসী সরাসরি স্রষ্টার ইবাদত করবে। ব্রোকার হিসেবে চার্চ, পোপ কিংবা পাদ্রীকে লাগবে না। চার্চের অফিশিয়াল শিক্ষাকে আকড়ে রাখা জরুরী না, বরং প্রত্যেক বিশ্বাসী নিজেই বাইবেল ব্যাখ্যা করতে পারবে। 

লুথারের মূল অর্থ এবং উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় এই ধারণার অবধারিত এবং যৌক্তিক উপসংহার হল চরম মাত্রার আপেক্ষিকতা। সবাই নিজের মতো করে দ্বীনকে ব্যাখ্যা করবে। সেই ব্যাখ্যা অনুযায়ী দলে দলে বিভক্ত হবে। ফলাফল হল অ্যানার্কি। বিশৃঙ্খলা। সবাই নিজ নিজ খেয়ালখুশিমতো ব্যাখ্যা করবে। প্রটেস্ট্যান্টদের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছে। সর্বনিম্ন এস্টিমেট অনুযায়ী প্রটেস্ট্যান্টদের ২০০-এর ওপর শাখা-উপশাখা আছে। অনেক হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি। টেক্সট ব্যাখ্যার কর্তৃত্ব যখন সবার থাকবে তখন সেটার অবধারিত

প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তার এইদিকগুলো আধুনিকতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আধুনিক চিন্তার ভিত্তির মধ্যে এধরণের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। যেমন – ধর্মকে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ করা।

মডার্নিটি মনে করে, বিশ্বাস করে ধর্মকে একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় হিসেব রাখা জরুরী। সবাই নিজে ব্যাখ্যা করবে, ব্যাখ্যা ভিন্ন হবে, ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মানুষ একমত হতে পারবে না। মীমাংস করার কোন মেকানিসম নেই। তাই ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হবে। সমাজ ও শাসনের ক্ষেত্রে ধর্মের জায়গায় আনতে হবে অন্য কিছু। চার্চের বদলে আনতে হবে রাষ্ট্রকে। পশ্চিমের ক্লাসিকাল লিবারেল চিন্তাবিদ থেকে শুরু করে আমাদের দেশের হাল আমলের লিবারেল মিশনারী পর্যন্ত সবাই এ যুক্তি ব্যবহার করে।

আধুনিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ র‍্যাডিকাল ইভিভিযুয়ালিসম (radical individualism)-এর শেকড়ের সাথেও প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তার সম্পর্ক পাওয়া যায়।

যেমনটা একটু আগে বললাম, Priesthood of all believers বা ‘সব বিশ্বাসী-ই পাদ্রী’-জাতীয় চিন্তার অবধারিত ফলাফল হল ধর্মের ব্যাখ্যাকে আপেক্ষিক করে ফেলা। ব্যাখ্যা করার জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্ব যেহেতু ব্যক্তির তাই সবাই নিজের মতো করে ধর্মকে ব্যাখ্যা করবে।

একটু বদলে নিয়ে মডার্নিটি এই অবস্থানকে  নিজের ভেতর ধারণ করেছে। মডার্নিটি ন্যায়অন্যায় আর নৈতিকতার ভিত্তি বানিয়েছে মানুষকে-ব্যক্তিকে-‘আমিত্ব’কে। সত্য আর নৈতিকতার মাপকাঠি হল ব্যক্তি। ব্যক্তিই এগুলোর সীমানা ঠিক করবে। অন্যের ক্ষতি কিংবা সামগ্রিক ক্ষতি না করার আগ পর্যন্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাধীন। যা ইচ্ছে তাই সে করতে পারবে।

ধর্ম যেহেতু ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে একটা ছোট্ট বাক্সের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাই নৈতিকতার হিসেব হবে সমান্তরাল অক্ষে। কোন ভার্টিকাল অক্ষ নেই। "সবার ওপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই"। ওপরের দিকে তাকানো যাবে না। মানুষের ওপরে থাকা, উচ্চতর কোন সত্ত্বার দোহাই দিয়ে ন্যায়-অন্যায়, ঔচিত্যের কথা বলা যাবে না। বেশি থেকে বেশি পাশের অন্য মানুষের দিকে তাকানো যাবে। যাচাই বাছাই হবে আমার ভালোলাগার ভিত্তিতে, অথবা অন্য মানুষের স্বার্থরক্ষার কথা মাথায় রেখে অথবা সামষ্টিক মানবিক বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে। সব হিসেব নিকেশ হবে মানুষিক সমতলে। একইভাবে মডার্নিটির ট্র্যাডিশান-বিরোধিতার শেকড়ও খুঁজে পাওয়া যায় প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তায়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা ও নৈতিক চিন্তা অনেকাংশে এই অবস্থানগুলোর ওপর নির্ভরশীল।

ইন্ট্রেস্টিংলি আধুনিক সময়ের যেসব তথাকথিত ‘কুরআন-ঔনলি মুসলিম’ আছে তাদের অবস্থান প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তার এ দিকগুলোর সাথে মিলে যায়। তারা হাদীসকে অস্বীকার করে, আলিমদের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং মনে করে কুরআন পড়েই কিংবা কুরআনের তরজমা পড়েই যে কেউ তা ব্যাখ্যা করতে পারবে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের এ অবস্থান নেয়ার কারণ হল কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যাকে মডার্নিটির ওয়ার্ল্ডভিউয়ের সাথে মেলাতে না পারা। তাই হাদীসকে অস্বীকার করে আধুনিকতার কাঠামোর ভেতরে তারা কুরআনকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে চায়। মডার্নিস্টদের ব্যাপারটাও অনেকটা একই ধরণের। ঢালাওভাবে হাদীস অস্বীকার না করলেও তারা মোটামুটি খেয়ালখুশি মতো হাদীস গ্রহণ-বর্জন করে। পাশাপাশি ইসলামের ইলমী সিলসিলা এবং আলিমদের জ্ঞানতাত্ত্বিক কর্তৃত্বকে খারিজ করে। তথাকথিত ‘আহলে কুরআন’ এবং মডার্নিস্ট চিন্তাধারার বিচ্যুতি তাই মডার্নিটির ভেতর থেকে জন্ম নেয়া। মডার্নিটির আগ্রাসনে দিশেহারা হয়ে তারা আসলে তিন-চারশো বছরের পুরনো ইউরোপীয় খ্রিস্টান মানহাজকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এরাই বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ এবং মুক্তচিন্তার দাবি করে!