মাদক ব্যবসা আর জুয়াকে কি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলা যায়?
..
এসব করে ব্যবসায়ী নিজে প্রচুর টাকা কামায়, এটুকু নিশ্চিত। কাজেই বলা যেতে পারে যে, মাদক ব্যবসা বা জুয়া ব্যবসায়ীর জন্য লাভজনক। কিন্তু এ ব্যবসাগুলোর কারণে সমাজের কী অর্থনৈতিক উন্নতি হয়? নতুন সম্পদ কি তৈরি হয় সমাজে? অবশ্যই না।

এমন অনেক কাজ আছে যেগুলোর মাধ্যমে নতুন সম্পদ তৈরি হয়। যেমন : কৃষক কিংবা ডাক্তারের সময় ও শ্রমের দ্বারা তৈরি হয় নতুন পণ্য বা সেবা (সম্পদ)। আবার অনেক কাজের মধ্য দিয়ে কেবল সম্পদের হাতবদল হয়। মাদক ব্যবসা, জুয়া, চুরি এ ধরনের কাজ। মাদক ব্যবসায়ীর কিংবা ক্যাসিনোর হাতে প্রতিদিন জমা হয় হাজারো মানুষের টাকা।

এর বাইরে ব্যাংকিং এবং ফাইন্যানশিয়াল মার্কেটের মতো অনেক বৈধ ইন্ডাস্ট্রিও এ ধরনের কাজের মধ্যে পড়ে। এগুলো বিশাল বড়, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি হতে পারে, কিন্তু কোনো ভ্যালু তৈরি করে না, কোনো নতুন সম্পদ তৈরি করে না। এখানে কেবল সম্পদের হাতবদল হয় এবং অধিকাংশ সময় অনেকের হাত থেকে সম্পদ বেরিয়ে গিয়ে জমা হয় অল্প কিছু হাতে।

সম্পদ তৈরি আর সম্পদের হাতবদল–দু-ধরনের কাজের মাধ্যমেই কিন্তু প্রফিট হয়। কৃষকও টাকা ইনকাম করে, পাবলো এস্কোবার আর ঔলফ অফ ওয়ালস্ট্রিটরাও করে। কিন্তু সমাজের ওপর দুদলের উপার্জনের প্রভাব বিপরীতমুখী। একটা ভ্যালু-অ্যাডিটিভ, আরেকটা ভ্যালু সাবস্ট্র্যাক্টিভ।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সের ব্যাপারে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পদ তৈরির বদলে সম্পদের হাতবদলকে প্রাধান্য দেয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্পদ তৈরির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর কারণ হলো প্রফিটকেন্দ্রিক চিন্তা এবং সবকিছুকে অর্থমূল্যে মাপার প্রবণতা। কয়েকটা সংখ্যায় নামিয়ে আনা যায় না সব ধরনের সম্পদকে। টাকা দিয়ে সবকিছুর মূল্য মাপা যায় না।

যে বাতাসে আমরা নিশ্বাস নিই, তার দাম কত? আমাদের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উন্নতি কিংবা অবনতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা কিংবা শিক্ষার মানকে আপনি জিডিপি, জিএনপির হিসাবে ঢুকাতে পারবেন না। অর্থনীতির খেরো খাতায় খুঁজে পাওয়া যাবে না এগুলোর হিসাব। কিন্তু তার মানে এই না যে এগুলো অর্থনৈতিকভাবে মূল্যহীন।

আজ উন্নতির এ ভুল অঙ্কের মাশুল দিতে হচ্ছে পুরো মানবজাতিকে। পুরো পৃথিবীজুড়ে এ মনোভাব গড়েছে যতটুকু, ধ্বংস করেছে তারচেয়ে অনেক বেশি। এ সংজ্ঞায়নে স্রষ্টাপ্রদত্ত অমূল্য সব নিয়ামত হয়ে যায় মূল্যহীন। হাজার বছরের পুরোনো বন কেটে উজাড় করার ক্ষতির কোনো বাজারমূল্য ধরা হয় না, কিন্তু সেই কাঠ বিক্রির অল্প কিছুকে টাকাকে বলা হয় সম্পদ। প্রাকৃতিক সম্পদকে ইসলাম ব্যবহার করতে বলে মানবজাতির কল্যাণের জন্য, কিন্তু প্রাইভেটাইযেইশানের মাধ্যমে অল্প কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আজ মানবজাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দোরগোড়ায়।

উন্নতি ও অগ্রগতির ফসলগুলো মানবজীবনের ওপর তাদের প্রভাবের ভিত্তিতে না মাপলে দিন শেষে সব ‘সম্পদ’ নিয়ে আমাদের রাজত্ব করতে হবে এক বিরান ধ্বংসস্তূপের ওপর।


শুভঙ্করের ফাঁকি : চিন্তাপরাধ