নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী এবং সংশয়বাদীদের কিছু রেডিমেইড ‘যুক্তি’ থাকে। যখন স্রষ্টা, পরকাল ও স্রষ্টার আনুগত্যের আবশক্যতার কথা বলা হয় তৎক্ষণাৎ এই মুখস্থ উত্তরগুলো তারা পেশ করেন, এবং মোক্ষম জবাব দিয়ে প্রতিপক্ষকে লা-জওয়াব করা গেছে এটা ভেবে পরিতৃপ্তি অনুভব করেন। এছাড়া যারা বিশ্বাস রাখেন কিন্তু বিশ্বাস সম্পর্কে তেমন একটা জ্ঞান রাখেন না, তাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করতেও নাস্তিকরা এসব রেডিমেইড “যুক্তি” ব্যবহার করেন।
এরকম মুখস্থ “যুক্তি”-র সংখ্যা সীমিত হওয়াতে দেখা যায় ঘুরেফিরে একই “যুক্তি” বিভিন্ন আঙ্গিকে সামনে আসছে। এরকম একটি “যুক্তি” হল – সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাধিক্য ও পারস্পরিক ভাবে সাংঘর্ষিক হবার “যুক্তি”। শুনতে যতো জটিল মনে হয় আসলে বাস্তবে বিষয়টা ততোটা জটিল না। সাধারণত এই “যুক্তি” প্রশ্ন আকারে উপস্থাপন করা হয়। যেমন -
পৃথিবীতে এতো ধর্মের মাঝে কোন ধর্মটি সঠিক? প্রতিটি ধর্ম নিজ নিজ স্রষ্টার কথা বলে, প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা দাবি করে একমাত্র তাদের ধর্মই সঠিক, একমাত্র তাদের ধর্ম অনুসরণ করেই মুক্তি পাওয়া যাবে। এর মাঝে আপনার ধর্ম যে সঠিক তার প্রমান কি?
নাস্তিকদের এই যুক্তিটির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে এবং আন্তরিকভাবে যদি কোন সাধারণ বুদ্ধিবিবেচনাসম্পন্ন ব্যক্তি চিন্তা করেন তাহলে তার মনে দ্বিতীয় আরেকটি এই প্রশ্নের উদয় হবার করা (তবে এক্ষেত্রে চিন্তার ক্ষেত্রে কিছুটা নিরপেক্ষ হওয়া এবং স্রষ্টার প্রশ্নের উত্তর খোজার ব্যাপারে আন্তরিক হওয়া আবশ্যক)। প্রশ্নটি হল, এই প্রশ্নের মাধ্যমে প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য কি? প্রশ্নকারী কি এই প্রশ্নের মাধ্যমে ওই বিষয়গুলোর উত্তর খুজতে সচেষ্ট যে প্রশ্নগুলো নিয়ে ধর্ম আলোচনা করে? অথবা যে প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে আস্তিক ও নাস্তিকদের মতপার্থক্য? স্রষ্টা, স্রষ্টার আনুগত্য, সৃষ্টির সূচনা, মানব অস্ত্বিতের লক্ষ্য, মৃত্যু, পরকাল, নৈতিকতা, ভালো ও মন্দ – ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট উত্তর খোজার লক্ষ্যে কি এ প্রশ্ন করা হচ্ছে? নাকি এটা কি কথার পিঠে বলা একটি কথা – একটি রেটোরিকাল যুক্তি?
প্রশ্নটা আরো স্পেসিফিক ভাবে করি। যেই যুক্তি বা প্রশ্নটা নাস্তিকরা উত্থাপন করছেন সেটা কি আদৌ সত্যকে খোজার সাথে সম্পর্কিত? নাকি সেটা একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট একটা কথোপকথনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য তৈরি করা একটি যুক্তি? সহজ ভাষায় এই প্রশ্নের পেছনে উদ্দেশ্য বা intent কি সত্যের অন্বেষণ নাকি তর্কে জেতা?
আপনি যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন প্রশ্নকারী ইতিমধ্যেই তার প্রশ্নের মাধ্যমে সম্ভাব্য সব উত্তরকে ভুল সাব্যস্ত করে বসে আছেন। এ প্রশ্নটা এমনভাবে তৈরি করা যাতে করে সম্ভাব্য যেকোন উত্তরকে গ্রহণ না করার জাস্টিফিকেশান তৈরি করা যায়। আপনি যে উত্তরই দিন না কেন সে বলবে – “তুমি এটা বলছো কিন্তু আরেকজন তো আরেকটা বলবে। তো আমি তোমাদের কার কথা শুনবো।”
অর্থাৎ উত্তর খোজাটা আদৌ প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্য না। সে আসলে আপনি কি উত্তর দেবেন তা শুনতে, কিংবা আপনার উত্তর সঠিক কি না তা পরীক্ষা করে দেখতেও আগ্রহী না। বরং তার উদ্দেশ্য হল সম্ভাব্য উত্তরগুলোর সংখ্যাধিক্য এবং পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক হবার বিষয়টি উত্থাপন করে সম্ভাব্য সকল উত্তর সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করা।
ধরুন আপনি একজন নাস্তিক। একজন ধর্মে বিশ্বাসী লোক – সেটা যেকোন ধর্ম হতে পারে – আপনাকে এসে প্রশ্ন করলো আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না কে? অথবা ধরুন আপনাকে প্রশ্ন করা হল আপনি কি বিশ্বাস করেন?
এক্ষেত্রে ধর্মে বিশ্বাসী লোককে উপরের প্রশ্ন করে আপনি ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিতে পারবেন – “কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করবো? কোন ধর্মে বিশ্বাস করবো? এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর কি? সঠিক উত্তর কিভাবে বের করবো, যখন সবাই বলছে তার উত্তরই সঠিক?”
এটুুকু বলে ধর্মে বিশ্বাসী লোকটাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাস্তিকরা বলে – “অতএব ধর্ম-টর্ম এগুলো মানুষ নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য এখন এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান এসব কিছু নেই, সব মানুষের বানানো…” ইত্যাদি।
প্রশ্ন হল যে প্রশ্ন থেকে এই আলোচনার শুরু সেই প্রশ্ন থেকে কি যৌক্তিকভাবে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায়? অনেক ধর্ম থাকা, এবং এ ধর্মগুলোর বক্তব্য সাংঘর্ষিক হওয়া কি সবধর্মের ভুল হবার প্রমান?
আলোচনা সম্ভবত একটু বেশি তাত্ত্বিক হয়ে যাচ্ছে, আমি একটা উদাহরণ দিয়ে জিনিষটা বোঝানোর চেষ্টা করি।
মনে করুন সমুদ্রপাড়ের একটি শহর। ধরুন হাজার বছর আগের কথা। একদিন সকালে শহরবাসী আবিষ্কার করলো একটি ছোট্ট নৌকা সৈকতে এসে ভিড়েছে। নৌকাতে অচেতন দুটি প্রাণী। একজন মূমুর্ষু ব্যক্তি এবং তার বুকে আনুমানিক ছয় মাসের একটি শিশু। লোকজন তাদেরকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করার কিছুক্ষন পরই লোকটি মারা গেলেন। তবে মৃত্যুর আগে কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান ফিরে পেয়ে কিছু তথ্য জানিয়ে গেলেন। শিশুটির মা তাদের সাথেই জাহাজে ছিলেন। জহাডুবি হওয়াতে তিনি এবং তার সন্তান জাহাজের অন্যান্য যাত্রীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। তিনি শহরের লোকেদের প্রতিজ্ঞা করালেন তার সন্তানকে দেখে রাখার এবং সন্তানের মা আসলে তার কাছে সন্তানটি তুলে দেবার। শহরের লোকজন আর কোন তথ্য লোকটির কাছ থেকে জানার আগেই তিনি মারা গেলেন।
ধরা যাক, এক বছর পর এক জাহাজে চেপে একশ জন মহিলা হাজির হলেন এবং সকলেই সেই শিশুটির মাতৃত্বের দাবি করে বসলো। একশ জনের একশ জনই নিজের দাবিকে আত্মবিশ্বাসের সাথে সত্য বলে প্রচার করতে থাকলো। নিজের দাবির স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি-প্রমান উপস্থাপন করলো। শহরের লোকজন পড়লো মহাসমস্যায়। কি করা যায় তা ঠিক করার জন্য এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকা হল।
বৈঠকে শহরের মেয়র দাঁড়িয়ে বললেন – উপস্থিত লোকসকল! আসুন দেখা যাক আমরা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কি জানি। আমরা জানি -
ক) একশ জনের প্রত্যেকেরই এ শিশুর মা হওয়া সম্ভব না। যদি একজনের দাবি সঠিক হয় তাহলে অবধারিত ভাবে বাকি ৯৯ জনের দাবি ভুল।
খ) এই একশো জনের মধ্যে আসলেই এ শিশুর মা উপস্থিত আছে – কেবলমাত্র তাদের দাবির ভিত্তিতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
গ) এই একশোজনের মাঝে শিশুটির প্রকৃত মা উপস্থিত নেই- এটাও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না।
ঘ) কোন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এ শিশুটির মা, সেটাও নিছক দাবির ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।
ঙ) যদি শিশুটির প্রকৃত মা এই একশো জনের মাঝে উপস্থিত থাকে তাহলে এটা আবশ্যক যে ৯৯% দাবিকারী এখানে মিথ্যা বলছে। আর যদি শিশুটির মা এখানে উপস্থিত না থাকে তাহলে এখানে ১০০% দাবিকারীই মিথ্যা বলছে।
হে শহরবাসী আপনারা বলুন আমরা কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারি?
মেয়রের কথার পর নেমে আসলো পিনপতন নীরবতা। মিনিট খানেক সবাই যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো। তারপর এক শিশু দাড়িয়ে বললো, আমি জানি এ সমস্যা সমাধান কি। যেহেতু সবাই বলছে তার দাবিই সঠিক, যেহেতু প্রত্যেকের দাবি অন্যান্যদের দাবির সাথে সাংঘর্ষিক এবং যেহেতু এখানে কমপক্ষে ৯৯% দাবিদার মিথ্যাবাদী - অতএব স্পষ্টভাবে প্রমান হয় যে এই শিশুটির আসলে কোন মা-ই নেই। আমরা ধরে নেবো নৌকায় চেপে আসা সেই ব্যক্তিও মিথ্যা বলেছে এবং মাতৃত্বের দাবিকারীরাও সবাই মিথ্যা বলছে। আর আমরা বিশ্বাস করবো এই শিশুটির কোন মা নেই, এবং তার কোন পিতাও নেই। পিতা ও মাতা ছাড়াই এ শিশু এসেছে। আর যেহেতু শিশুটির কোন মা নেই, পিতাও নেই, তাই সেই ব্যক্তির কাছে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এটা মানতেও আমরা আর বাধ্য নেই।
এই শিশুটির কথাকে কি যৌক্তিক? হত পারে সে অবুঝ, পাগল, প্রতিবন্ধী অথবা সে সঠিক উত্তর খুজতেই চায় না। কিন্তু তাকে কি আদৌ সত্যান্বেষী বলা যায়?
নাস্তিকদের “যুক্তিটি” এবং যুক্তির ভিত্তিতে দেওয়া তাদের উপসংহার হল এই শিশুর কথার মতো। যেহেতু সবাই নিজেকে ঠিক দাবি করছে, যেহেতু অনেকে দাবি করছে -তাই সব ধর্মই নিশ্চিতভাবে ভুল এবং কোন স্রষ্টা নেই!
ধর্মের সংখ্যাধিক্য এবং ধর্মগুলোর বক্তব্য পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হওয়া প্রতিটি ধর্মের ভুল হবার প্রমান না, যদিও এটা অবধারিত যে সবগুলো ধর্ম সঠিক হতে পারেন না। একই ভাবে অনেকগুলো ধর্ম থাকা, প্রতিটি ধর্মের বিভিন্ন বক্তব্য থাকা স্রষ্টার অনস্তিত্বের প্রমান না।
যদি সমুদ্রপাড়ের শহরের মানুষ আসলেই সমস্যার সমাধান করতে চায় তবে তাদেরকে হয় মাতৃত্বের দাবিকারীরা কি কি দলিল-প্রমান উত্থাপন করেছে তা পরীক্ষা করতে হবে, অথবা অন্য কোন পদ্ধতিতে শিশুটির মাতৃপরিচয় সম্পর্কে তাদের নিশ্চিত হতে হবে। সমস্যা বেশ জটিল তাই ধরে নিলাম এই শিশুর মা নেই, বাবা নেই – এটা কোন সমাধান না। তাই নাস্তিকরা যা বলে তা না কোন প্রমান, না কোন সঠিক উত্তর। বরং তারা প্রমানহীন, যৌক্তিকতাহীন আরেকটি দাবি, আরেকটি বিলিফ সিস্টেম বা ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আসেন। আর তা হলঃ কোন স্রষ্টা নেই, অতএব স্রষ্টাকে মানার প্রয়োজনও নেই। [1]
কিন্তু যেখানে তারা ভাওতাবাজি করেন বুঝে কিংবা না বুঝে তা হল – দুনিয়ার সব ধর্মকে যদি তারা ভুল প্রমান করেনও (যেটা তারা করতে পারেন না) তবুও কিন্তু স্রষ্টার অনস্তিত্ব – স্রষ্টা নেই – এটা প্রমাণিত হয় না। সুতরাং অন্য ধর্মে কেন ভুল বা প্রত্যেক ধর্মের ভুল হবার ৯৯% সম্ভাবনা আছে – এধরণের কথা না বলে তাদের উচিৎ এটা প্রমান করে দেখানো যে স্রষ্টা নেই। কিন্তু তারা এই কাজটা করেন না। তারা বরং আলোচনাকে ডাইভার্ট করেন বা ভিন্নখাতে প্রভাবিত করেন, এবং কথার মারপ্যাঁচ এবং রেটোরিকাল যুক্তি দিয়ে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু অপরের দাবির ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টি তাদের দাবির পক্ষে প্রমান না।
অর্থাৎ নাস্তিকদের অবস্থানটা হল এই – তারা বিশ্বাস করেন স্রষ্টা নেই। কিন্তু তারা তাদের এই দাবির পক্ষে প্রমান উত্থাপন করতে পারেন না। তারা স্রষ্টা আছে এই দাবিকে ভুলও প্রমান করতে পারেন না, এবং মহাবিশ্বের উৎস ও সূচনার কারন হিসেবেও কোন সন্তোষজনক উত্তর তারা দিতে পারেন না। বরং তারা একটা স্ট্যাটিস্টিকাল পয়েন্টে তর্কটা নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। তারা বলতে চান – যদি অনেক ধর্ম থাকে আর এর মধ্যে শুধু একটি ধর্মই সঠিক হতে পারে, তাহলে স্ট্যাটিস্টিকালি একজন নাস্তিকের অবিশ্বাস ততোটাই যৌক্তিক যতোটা একজন বিশ্বাসীর বিশ্বাস। দুটোরই ভুল হবার সম্ভাবনা। [তাদের এই অবস্থানের মাঝেও একটা ভুল আছে, তবে সেই আলোচনাতে এখন যাচ্ছি না।]
সমস্যাটা হল কোন চায়ের আড্ডায়, কিংবা তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রে এধরনের আর্গুমেন্টের ব্যবহার হয়তো একজন নাস্তিকের পযিশানকে অপরের সামনে জাস্টিফাই করার ক্ষেত্রে কার্যকর, কিন্তু মূল বিষয়ে – অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্কের বিষয়ে - পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোন কিছুই এ ধরণের আর্গুমেন্ট থেকে পাওয়া যায় না। আপনি যদি দুনিয়ার সব ধর্মকে ভুল প্রমাণিত করেনও তাও কিন্তু এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া হয় না।
এই স্ট্যাটিস্টিকাল পয়েন্টটা এমন সব প্রশ্নের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর একটি। কারন যেকোন প্রশ্নের একটি মাত্র উত্তর সঠিক হবার অর্থ অবশ্যই অন্য সকল উত্তর ভুল। ধরুন একটি কাঁচের জারে নির্দিষ্ট সংখ্যক বিভিন্ন আকার ও রঙের ছোট ছোট রাবারের বল আছে। আপনি যদি জারটি এক নজর দেখিয়ে তারপর মানুষকে প্রশ্ন করেন – বলুন তো এখানে কয়টি বল আছে?
তাহলে এ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যা অসীম। যদি ১০০০ জনকে প্রশ্ন করেন হয়তো ১০০০টা ভিন্ন ভিন্ন উত্তর পাবেন। কিন্তু তার অর্থ কি এ প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই? অবশ্যই না। অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বল সেই জারে থাকবে, এই সংখ্যা বদলাবে না। অবশ্যই সঠিক উত্তর একটিই হবে এবং তা ছাড়া বাকি সব উত্তর ভুল হবে। সম্ভাব্য উত্তরের সংখ্যাধিক্য ও তাদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হওয়া প্রমান করে না যে, সঠিক উত্তর নেই।[2]
ধর্মের অনুসরণ, ধর্মীয় অনুশাসন পালন এগুলো স্রষ্টায় বিশ্বাসের পরবর্তী ধাপ। আবশ্যক প্রথম ধাপ তর্কে জেতা কিংবা নিজের অবস্থানকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সত্যের অন্বেষণ না। একজন সত্যান্বেষী ব্যক্তি যিনি সংশয়ে আছেন তিনি প্রথমে এই প্রথম ধাপের মীমাংসা করার চেষ্টা করবেন। আর একজন ক্যারিয়ার নাস্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে তর্কে জেতার চেষ্টা করবে।
সুতরাং যদি কোন নাস্তিক পরবর্তীতে এই প্রশ্ন আপনার সামনে উপস্থাপন করেন তাহলে যদি কেউ তর্কে জিততে চান তাহলে তাকে বলুন – যদি আমি ধরে নেই দুনিয়ার সব ধর্মই ভুল, তবুও তো সব ধর্মের ভুল হওয়া তোমার বিশ্বাসকে (নাস্তিকতার বিশ্বাস – স্রষ্টা নেই, পরকাল নেই, স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির দায়বদ্ধতাও নেই) সত্য প্রমান করে না। তাই তাদের ভুল তোমার পক্ষে প্রমান না। বরং তুমি তোমার দাবির পক্ষে প্রমান পেশ করো। আর যদি তুমি সেটা না পারো তাহলে অন্ধ বিশ্বাসী আর অন্ধ অবিশ্বাসী তোমার মধ্যে পার্থক্য কি?
আর তাই যদি আসলেই কেউ সত্যান্বেষী হন তাহলে এসব মুখস্থ প্রশ্ন বাদ দিয়ে তার উচিত ভিন্ন একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। রেটোরিকাল কুতর্ক ছেড়ে মূল বিষয়ে প্রশ্ন করা, শেকড় থেকে শুরু করা। প্রশ্নটি হল –
এই মহাবিশ্বের অরিজিন কি? পৃথিবী, সৌরজগত, ছায়াপথ নীহারিকা থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রন, প্রোটন পর্যন্ত - ম্যাক্রো স্কেল থেকে শুরু করে ন্যানো স্কেল পর্যন্ত – এসব কিছু কি নিজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে? নাকি এগুলো নাকি এগুলো সবসময় ছিল এবং সবসময় থাকবে? নাকি এগুলো নির্দিষ্ট এক পর্যায়ে শুরু হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পর বিলীন হয়ে যাবে – আর এর পুরোটাই হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে? নাকি এসব কিছুর একজন স্রষ্টা আছেন?
[1] এক্ষেত্রে অনেকে একটি যুক্তি দিতে পারেন - ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শিশুর মাতৃত্ব নির্ণয় সম্ভব, কিন্তু এমন কোন পরীক্ষা কি আছে যা দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব (বা অনস্তিত্ব) প্রমান সম্ভব?
এই যুক্তি দুটী কাঠামোগত কারণে ভুল। প্রথমত, এই উদাহরন বা থট এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে স্রষ্টার অস্তিত্বকে প্রমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে না। এখানে শুধু এটাই উপস্থাপন করা হচ্ছে যে একাধিক সাংঘর্ষিক দাবির থাকার অর্থ এই না যে - সকল দাবি মিথ্যা। অনেক সাংঘর্ষিক দাবি থাকার অর্থ এই না যে বিষয়ে দাবি করা হচ্ছে সেই বিষয় অস্তিত্বহীন। যেহেতু অনেক সাংঘর্ষিক দাবির কারণে বলা যায় না - পিতামাতা ছাড়া শিশুটি অস্তিত্বে এসেছে। এখানে বলা হচ্ছে, স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিতভাবে প্রমান করার কোন উপায় না থাকা সত্ত্বেও, স্রষ্টার ব্যাপারে অনেক সাংঘর্ষিক দাবি থাকার কারণে স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই - এমন কথা বলা সম্পূর্নভাবে অযৌক্তিক। সুতরাং এখানে স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু নাস্তিকতার পক্ষে উপস্থাপিত একটি যুক্তির ফ্যালাসিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, একটি থট এক্সপেরিমেন্টের নির্দিষ্ট একটি ভিত্তি বা premise থাকে। এর বাইরে গিয়ে থট এক্সপেরিমেন্টের সমাধান করা যায় না। বক্সের মধ্যে একটি ভিডিও ক্যামেরা রেখে দিলেই বা একটা এক্সরে মেশিন ব্যবহার করলেই তো জানা যায় শ্রডিঞ্জারের বিড়াল জীবিত নাকি মৃত - চা-র দোকানের এই উত্তর শুনতে হয়তো যৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি এভাবে চিন্তা করছে সে থট এক্সপেরিমেন্টের উদ্দেশ্য, premise, কাঠামো - কোনটাই বোঝে নি।
একইভাবে এই লেখার থট এক্সপেরিমেন্টে হাজার বছর আগের একটি সমুদ্র পাড়ের শহরের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটি অবস্থার কথা বলা হয়েছে যেখানে দাবিকৃত বিষয়ের ব্যাপারে (অর্থাৎ মাতৃত্ব নির্নয়) নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই। যদি শিশুটির মা কে তা নিশ্চিতভাবে নির্নয়ের উপায় থাকেই তাহলে শহরবাসীর বৈঠক করা, এ নিয়ে চিন্তিত হওয়া, এ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান খোজা - এসব কিছুরই প্রয়োজন হয় না। কেউ যদি এখন বলে বসেন এখানে ডিএনএ টেস্ট করলেই তো হয় - তাহলে সম্ভবত আলোচনা তার জন্য খুব জটিল হয়ে গেছে, অথবা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন নি। যেটাই হোক তার উচিৎ এই আলোচনাতে অংশগ্রহন এবং নিজেকে হাস্যস্পদ করা থেকে বিরত থাকা।
[2] নাস্তিকরা বলতে পারেন এই উদাহরণ তৈরি করা হয়েছে পিতামাতা ছাড়া শিশু জন্মাতে পারে না এই প্রমানিত বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে। জারের উদাহরনেও জারের মধ্যে বল আছে আগে এটা ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্রষ্টা আছে সেটা একইভাবে প্রমাণিত না। তাই এটি একটি False Analogy.
সেই ক্ষেত্রে উত্তর হবে, এটি False Analogy না, কারন এ থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের চেষ্টা করা হচ্ছে না। শিশুর জন্য যেহেতু পিতামাতা থাকা আবশ্যক, তাই অবশ্যই মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা থাকা আবশ্যক – এই যুক্তি এখানে দেওয়া হচ্ছে না। এখানে শুধু বলা হচ্ছে দাবিদার অনেক হওয়া, কিংবা অধিকাংশ বা সকল দাবিকারীর দাবির মিথ্যা হওয়াও প্রমান করে না যে শিশুটি পিতামাতা ছাড়া জন্মেছে।সম্ভাব্য উত্তর অনেক হওয়া প্রমান করে না যে জারে কয়টি বল আছে এই প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই। একইভাবে অনেক ধর্ম থাকা এবং তাদের বক্তব্য পারস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক হওয়াও কোন ভাবেই প্রমান করে না যে স্রষ্টা নেই। স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রশ্নটা কোন নির্দিষ্ট ধর্মের সঠিক বা বেঠিক হবার উপর নির্ভরশীল না কোন ভাবে সংযুক্তও না।
বরং আমরা এটাই বলছি যে ধর্মের সংখ্যা, ধর্মের বক্তব্য, তাদের পারস্পরিক সংঘাত ইত্যাদি ছেড়ে মূল আলোচনায় আসুন। অহেতুক পানি ঘোলা করা বাদ দিয়ে, মূল প্রশ্নের মীমাংসা করুন, একজন বা একাধিক স্রষ্টা আছেন কি না, সেই আলোচনায় আসুন।