শরীয়াহতে একজন মুসলিমের জীবনের দাম কত, সেটা বুঝতে হবে, মনে রাখতে হবে। মুসলিমের জান-মাল-সম্পদের নিরাপত্তা শরীয়াহর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি। যদি আপনি জানতে চান কোনো রাষ্ট্র আসলেই শরীয়াহ দ্বারা শাসিত হয় কি না, তাহলে সেই রাষ্ট্রে মুসলিমের রক্তের মূল্য কত, সেটা দেখুন।
আজকের তথাকথিত উন্নত বিশ্ব গর্ব করে বলে, তারা নাকি মানবাধিকার রক্ষায় সেনাবাহিনী পাঠায়। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি মহান দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ। মদীনার ইহুদী গোত্র বনু কায়কুনার কয়েকজন মিলে একজন মুসলিম নারীর পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল। প্রতিবাদে একজন মুসলিম এগিয়ে আসায় তাঁকে হত্যা করেছিল এই ইহুদীরা। এ অপরাধের কারণে রাসূলুল্লাহ ﷺ মুসলিম বাহিনী নিয়ে পুরো বানু কায়নুকাকে গোত্রকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তারপর মদীনা থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। আজ যখন আমাদের মুসলিম বোনদের ধর্ষিত হবার খবর শুনবেন তখন এ দৃষ্টান্তের কথা মনে রাখবেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধির আগে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, মক্কার মুশরিকরা উসমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)-কে হত্যা করেছে। শুধু একজন মুসলিমের রক্তের প্রতিশোধ নিতে জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ তখন তাঁর সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-দের কাছ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করার শপথ নেন। ইতিহাসে এ ঘটনা বাইয়াতুর রিদ্বওয়ান নামে প্রসিদ্ধ।
মু’তার যুদ্ধের আগে গ্বাসসান গোত্র যখন বসরায় পাঠানো রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দূতকে হত্যা করে, তখন তিনি এক সেনাবাহিনী পাঠান। তিনি ﷺ জানতেন যে এ এক অসম যুদ্ধ হবে। কাফিরদের সংখ্যা ছিল অনেক, অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ ﷺ তবুও মুসলিম বাহিনীকে পাঠিয়েছিলেন। কারণ, একজন মুসলিমের জীবনের গুরুত্ব এবং একজম মুসলিম আক্রান্ত হলে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত, তার দৃষ্টান্ত পুরো পৃথিবী এবং পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যে তিনি ﷺ রেখে যেতে চেয়েছিলেন।
মা’আন অঞ্চলের গর্ভনর ফারওয়া বিন আমার আল জুদানী খ্রিষ্ট ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন তাঁকে হত্যা করা রোমানরা। এই হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রস্তুত করেন উসামা বিন যাইদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীকে।
ইসলামী রাষ্ট্রে আর কেউ একজন মুসলিমের চেয়ে বেশি মূল্যবান না। এমনকি যেসব মুসলিম খালিফাহরা যুলুম করতেন তারাও শত্রুর সামনে মুসলিমের রক্তের এই পবিত্রতা টিকিয়ে রাখতেন। আব্বাসী খালিফাহ আল-মু’তাসিম যালিম শাসক হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু একজন মুসলিম নারী যখন রোমানদের হাতে বন্দী হবার পর চিৎকার করে বললেন, ওয়া মু’হতাসিমা! হে মু’হতাসিম! তুমি কোথায়? তখন একজন মুসলিম নারীর জন্য তিনি এক সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন।
কিছু মূর্খ মু’হতাসিমের সাথে আজকের শাসকদের তুলনা করতে চায়। তারা বলতে চায়—মুহ’তাসিমও যুলুম করত আর আজকের শাসকেরাও যুলুম করে। তাই তারা একই শ্রেণির। তাদের প্রতি আমাদের আচরণ একই রকম হওয়া উচিত। কী নির্বোধের মতো কথা!। ‘হে মু’হতাসিম’, এর মতো চিৎকার আজ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর নানান কোনায় আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমাদের নির্যাতিত বোনদের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদের ধ্বনি আজকের এ শাসকদের কানেও পৌঁছেছে। কিন্তু তা তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেনা। অন্যদিকে সেই মুসলিম নারীর আর্তনাদ স্পর্শ করেছিল মু’হতাসিমের হৃদয়কে। একজন মুসলিম নারীর চিৎকারে প্রকম্পিত হয়েছিল মু’তাসিমে বুক। জ্বলে উঠেছিল আগুন। কিন্তু আজ হাজার হাজার মুসলিম বোনের চিৎকার শোনার পরও এসব শাসকদের অন্তরে মর্যাদাবোধ, ক্রোধ আর প্রতিশোধস্পৃহা জাগে না।
যখন নাভার রাজ্যের খ্রিষ্টানরা আন্দালুসের তিন জন মুসলিম নারীকে বন্দী করেছিল তখন তাঁদের মুক্ত করার জন্য একটি বাহিনী পাঠিয়েছিলেন আল-হাজ্জ বিন মানসুর। তাই ইউরোপ তাঁকে সম্মান করত। ভয় পেত। তার মৃত্যুর পর তখন ইউরোপ উৎসব করেছিল। আজকের কোন শাসক মারা গেলে কাফিররা উৎসব করবে? বরং এসব শাসকদের কেউ যখন অসুস্থ হয় তখন পশ্চিমারা তার জন্য প্রাইভেট জেট পাঠিয়ে দেয়। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় ইউরোপের সেরা হাসপাতালে। যেন সুস্থ-সবল করে তাকে আবার মুসলিমদের খুন করতে আর আল্লাহ -এর দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠানো যায়।
মুসলিমের রক্তের প্রকৃত মূল্য আমার মনে রাখতে হবে। এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। আমাদের জানতে হবে শরীয়াহতে একজন মুসলিমের রক্ত কতটা মূল্যবান। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ মুসলিমের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কী বলেছেন, সেটা জানতে হবে, পরস্পরকে জানাতে হবে। সত্যিকারের ইসলামী রাষ্ট্রে প্রতিটি মুসলিমের জীবন, সম্পদ ও সম্মান সুরক্ষিত থাকে। যখন সে আক্রান্ত হয় তখন তার প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসে রাষ্ট্র। যখন কেউ তার অধিকার ছিনিয়ে নেয়, রাষ্ট্র তখন সেই হামলাকারীর কাছ থেকে তার অধিকার ফিরিয়ে আনে।
আমরা এই শরীয়াহ এবং এমন ইসলামী রাষ্ট্রের দিকেই আহ্বান করি।
মুসলিমের রক্ত আজ সস্তা কেন?
ড. ইয়াদ আল-কুনাইবীর
#আয়নাঘর থেকে